en

বিদ্রোহী কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম

বিদ্রোহী কবিতা বাংলা সাহিত্যে নজরুলের এক অমর কীর্তি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে থাকা অন্যায় অবিচার এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেতনা থেকেই বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেছেন। কবি বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ সালে রচনা করেন। তারুণ্যের শক্তিতে উদ্দীপ্ত কবি যতক্ষণ পর্যন্ত না উৎপীড়িতের কান্নার ধ্বনি বন্ধ হবে ততদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। যৌবনের প্রাচুর্যে ভরপুর কবিতা প্রেমীদের জন্য বিদ্রোহী কবিতাটি শেয়ার করা। কবিতাটি ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তারুণ্যের বাণী ছড়িয়ে দিন।


বল বীর-

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

বল বীর-

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,

উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!

মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল বীর-

আমি চির উন্নত শির!

 

আমি চিরদূর্দমদুর্বিনীতনৃশংস,

মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ,আমি সাইক্লোন,আমি ধ্বংস!

আমি মহাভয়,আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,

আমি দুর্বার,আমি ভেঙে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,আমি দ’লে যাই যত বন্ধন,যত নিয়ম কানুনশৃঙ্খল!

আমি মানি না কো কোন আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবিআমি টর্পেডো,আমি ভীম ভাসমান মাইন!

আমি ধূর্জটি,আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর

আমি বিদ্রোহী,আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!

বল বীর-

চির-উন্নত মম শির!

 

আমি ঝঞ্ঝা,আমি ঘূর্ণি,

আমি পথ-সমুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।

আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,

আমি আপনার তালে নেচে যাইআমি মুক্ত জীবনানন্দ।

আমি হাম্বার,আমি ছায়ানট,আমি হিন্দোল

আমি চল-চঞ্চল,ঠমকি’ ছমকি’

পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’

ফিং দিয়া দিই তিন দোল ;

আমি চপলা-চপল হিন্দোল।

আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা

করি শত্রুর সাথে গলাগলিধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা

আমি উন্মাদ,আমি ঝঞ্ঝা!

আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;

আমি শাসন-ত্রাসনসংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।

বল বীর-

আমি চির-উন্নত শির!

 

আমি চিরদুরন্ত দুর্মদ,

আমি দুর্দমমম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্ হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।

আমি হোমশিখাআমি সাগ্নিক জমদগ্নি,

আমি যজ্ঞআমি পুরোহিতআমি অগ্নি

আমি সৃষ্টি আমি ধ্বংস আমি লোকালয় আমি শ্মশান,

আমি অবসান নিশাবসান।

আমি ইন্দ্রাণীসুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য;


আমি কৃষ্ণকন্ঠমন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির।

আমি ব্যোমকেশধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।

বল বীর –

চির-উন্নত মম শির!


আমি সন্ন্যাসীসুর-সৈনিক,

আমি যুবরাজমম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।

আমি বেদুঈনআমি চেঙ্গিস

আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!

আমি বজ্র আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার

আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার

আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূলধর্মরাজের দন্ড

আমি চক্র ও মহা শঙ্খআমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!

আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসাবিশ্বামিত্র-শিষ্য

আমি দাবানল-দাহদাহন করিব বিশ্ব।

আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস– আমি সৃষ্টিবৈরী মহাত্রাস,

আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!

আমি কভূ প্রশান্ত-কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী

আমি অরুণ খুনের তরুণআমি বিধির দর্পহারী!

আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাসআমি বারিধির মহা কল্লোল

আমি উজ্জ্বলআমি প্রোজ্জ্জ্বল,

আমি উচ্ছল জল-ছল-ছলচল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!


আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণুতন্বী-নয়নে বহ্ণি

আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দামআমি ধন্যি!

আমি উন্মন মন উদাসীর,

আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাসহা হুতাশ আমি হুতাশীর।


আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারাযত পথিকের

আমি অবমানিতের মরম বেদনাবিষ–জ্বালাপ্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের

আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতাব্যথা সুনিবিড়

চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!

আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনিছল-ক’রে দেখা অনুখন

আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা তা’র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্!

আমি চির-শিশুচির-কিশোর

আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!

আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া

আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণীবেণু-বীণেগান গাওয়া।

আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসাআমি রৌদ্র-রুদ্র রবি

আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝরআমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!

আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলিএ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!

আমি সহসা আমারে চিনেছিআমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!


আমি উথ্থান আমি পতন,

আমি অচেতন-চিতে চেতন,

আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তীমানব-বিজয়া-কেতন।

ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া

স্বর্গ মর্ত্য-করতলে

তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার

হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!


আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রিবাড়াব-বহ্ণিকালানল

আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!

আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,

আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি ভূমিকম্প।


ধরি বাসুকির ফণা জাপটি-

ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনেরপাখা সাপটি।

আমি দেব শিশু আমি চঞ্চল,

আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!

আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,

মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম

ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম

মম বাঁশরীর তানে পাশরি

আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।

আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,

ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!

আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,

কভু ধরনীরে করি বরণীয়াকভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা

আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!

আমি অন্যায় আমি উল্কা আমি শনি,

আমি ধূমকেতু-জ্বালাবিষধর কাল-ফণী!

আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী আমি রণদা সর্বনাশী,

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!


আমি মৃন্ময় আমি চিন্ময়

আমি অজর অমর অক্ষয় আমি অব্যয়।

আমি মানব দানব দেবতার ভয়,

বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,

জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!

আমি উন্মাদআমি উন্মাদ!!

আমি চিনেছি আমারেআজিকে আমার খুলিয়াগিয়াছে সব বাঁধ!!




আরও পড়ুন:-

কপিরাইট © ২০১৮ রংতুলি চয়েস ইনফো