en

বাঙ্গালীর বিনোদনের একাল সেকাল

আমরা বাঙ্গালি, স্বভাবতই একটু বিনোদন প্রিয় জাতি। বাঙ্গালীর কথায় বিনোদন, বাঙ্গালীর কাজে বিনোদন আর আড্ডা পেলেতো আর কোন কথাই নেই। বহু শতাব্দী ধরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এই ভূখণ্ডে হাঁসি আনন্দের সাথে বাস করে আসছি। কালের বিবর্তনে এই সকল বিনোদনের উৎসের পরিবর্তন হয়তোবা চোখে পড়ে না কিন্তু আগেকার বিনোদনের উপায় এবং এখনকার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আগেকার সময় বাঙ্গালীর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে নিজস্ব সংস্কৃতির উপর নির্ভর করতো আর এখন ধার করা সংস্কৃতি। বিনোদনের মাধ্যমের সাথে সাথে আমাদের রুচিবোধ এবং মূল্যবোধেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন ইতিবাচিক কিংবা নেতিবাচক সেটা এখনকার মানুষের মূল্যবোধ এবং আগেকার মানুষের মধ্যে পার্থক্য করলে খুব সহজেই বোঝা যায়।আগেকার বিনোদন: বাংলাদেশের তথা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আগেকার সময়ের বিনোদনের মাধ্যমগুলো ছিল আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য নির্ভর। সেই সকল গান, কবিতা, ছড়া, রূপকথা, যাত্রা পালার মধ্যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আবহ চিত্রায়িত করা হত নিপুণভাবে।

আগেকার এই সকল বিনোদন মানুষের মধ্যে সুপ্ত আবেগকে জাগিয়ে তুলত। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে জারি গান, সারি গান, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি গান, বাউল গান ইত্যাদি। বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র এই সকল গানের সুর শোনা যেত।

এই সব গানে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, নিত্যদিনের দুর্ভোগ আর দুর্দশার সুর ভেসে উঠত। গ্রামের পথ দিয়ে হেটে গেলে দুর হতে ভেসে আসত রাখালের বাঁশির সুর যা যেকোনো মানুষের মন কেড়ে নিত। বাংলাদেশের গ্রাম এলাকার মানুষ সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করে রাতের বেলায় বাড়ির আঙ্গিনায় বসে মাজ রাত পর্যন্ত বাউল গান শোনা।

এই সব ছিল মানুষের বিনোদনের অন্যতম উৎস। সহজ সরল মানুষ এই সব মাধ্যম থেকে নির্মল বিনোদনের স্বাদ গ্রহণ করতো। তখনকার সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে পরের দুঃখ কীভাবে ভাগাভাগি করা যায় সেই শিক্ষা দিত। মানুষের মধ্য থেকে সামাজিক কুসংস্কার দূর করা এবং ধর্মীয় ও নৈতিকতার শিক্ষা দানের ক্ষেত্রেও এই সকল উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। মোটকথা আগেকার দিনের রূপকথার গল্প এবং কেচ্ছা কাহিনী সামাজিক নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।

কিন্তু দিনের পর দিন অন্যের ধার করা সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতি আজ সংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার। এই জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। চাকচিক্যময় পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের নানা ভাবে আকৃষ্ট করছে। একবারও এর ক্ষতিকারক দিকগুলোর কথা ভাবিনি।

বাঙ্গালীর কথা এবং আচরনে পশ্চিমাদের অনুসরণ খুবই দুঃখজনক। এখন পশ্চিমা ব্যান্ড কনসার্ট-এর আয়োজন করা হয়। পশ্চিমা ঢঙে সিনেমা তৈরি করা হয় যা ছড়িয়ে পড়ছে জনসাধারণের মধ্যে। আমাদের পোশাক আশাকের মধ্যে পশ্চিমা ফ্যাশন। এই সব কারনে বাঙ্গালীর নিজস্ব সত্তা আজ হুমকির সম্মুখীন।

নিজেদের সংস্কৃতি বিলিয়ে দিয়ে বিড়ম্বনাও কম পোহাতে হয়নি। এখন বিশ্ব দরবারে বাংলা সংস্কৃতি এক অবহেলিত সময় পার করছে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলার অবস্থান পৃথিবীর চতুর্থ কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই বাংলাকে তার সঠিক মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না।

ইন্টারনেটের দিকে লক্ষ করলে দেখবেন কোন জায়গায় বাংলার স্বীকৃতি নেই। অন্য দেশের সংস্কৃতি প্রবেশের ফলে আমাদের স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখীন। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আগ্রাসনের ফলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অঘটন ঘটেই চলেছে। সন্ধ্যা হলেই বাংলাদেশের মহিলা এবং এমনকি পুরুষরাও ভারতীয় সিরিয়ালে ডুব দেয়।

এতে করে নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ যেমন কমছে তেমনই অন্যের সংস্কৃতি নিজের মাঝে ধারন করছে অকপটে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের কোন চ্যানেল ভারতে প্রদর্শন করা হচ্ছে না। যার ফলে বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ।

এখন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাকালে দেখতে পাবেন সেখানে ছোট খাট কোন অনুষ্ঠানে ভারতীয় গান চলছে এমনকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানেও ভারতীয় গান লাগিয়ে নৃত্য প্রতিযোগিতা করা হচ্ছে। এর ফলে অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। তাছাড়া, সামাজিক অস্থিরতা বেড়েই চলছে ক্রমাগত। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ রাষ্ট্র সর্বত্র একটা অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রেখে পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে বাঁচতে হলে অনতিবিলম্বে বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চা এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসারে সবাইকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতি তথা অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনাকে ত্যাগ করতে হবে। প্রত্যেকের ঘরে ঘরে নৈতিকতা ভিত্তিক সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। মোটকথা আমারা কারা, আমাদের সেই ইতিহাস জানতে হবে এবং আবার আমাদের সেই সুনালী দিনকে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে কাজ করতে হবে।

আরও পড়ুন:-

কপিরাইট © ২০১৮ রংতুলি চয়েস ইনফো